বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় পাহাড়ে জঙ্গি ক্যাম্প তৈরি করা নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া অত্যাধুনিক অস্ত্র সংগ্রহ করছে। তাদের কাছে একাধিক একে ফরটি সেভেন, একে টোয়েন্টি-টু রাইফেলসহ ছোট-বড় অনেক অস্ত্র রয়েছে। সম্প্রতি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির একটি পাহাড়ি এলাকা থেকে তিনটি দেশীয় পিস্তল, ছয়টি একনলা বন্দুকসহ ১৫০ রাউন্ড গুলি উদ্ধারের পর জঙ্গিদের অস্ত্রভাণ্ডারের বিষয়টি নতুন করে আবার আলোচনায় এসেছে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, পাহাড়ি এলাকার বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের কাছ থেকে জঙ্গিরা বেশ কিছু অত্যাধুনিক অস্ত্র সংগ্রহ করেছে। এসব অস্ত্রসহ পালিয়ে থাকা জঙ্গিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। তারা বিভিন্ন হিজরতকারীর প্রশিক্ষণের সময় ডামি অস্ত্র ব্যবহার করলেও মাঝেমধ্যেই আসল অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ দিত। আমরা একটা বড় অস্ত্রের মজুত উদ্ধার করেছি। এখন শামীন মাহফুজকে ধরতে পারলে তাদের পুরো অস্ত্রভাণ্ডার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে এবং উদ্ধার করা যাবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত মাসে পাহাড়ের জঙ্গি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা সাইফুল ইসলাম তুহিন ও নাঈম নামে দুই তরুণকে গ্রেপ্তার করে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। তারা প্রায় এক বছর ধরে পার্বত্য এলাকার একাধিক জঙ্গি ক্যাম্পে অবস্থান করেছে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তারা পাহাড়ের জঙ্গি ক্যাম্পের আদ্যোপান্তসহ কতগুলো অস্ত্র রয়েছে তারও বিস্তারিত জানিয়েছে। তুহিন ও নাঈমের আগে আরও একজন তরুণ পাহাড়ের জঙ্গি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। পরে তাকে আদালতে সোপর্দ করলে তিনি সাক্ষী হিসেবে ২২ পৃষ্ঠার জবানবন্দি দিয়েছেন। ওই জবানবন্দিতেও পাহাড়ি ক্যাম্পে জঙ্গিদের অত্যাধুনিক অস্ত্র সংগ্রহের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, পাহাড় থেকে পালিয়ে আসা জঙ্গি ও অন্যান্য গোয়েন্দা তথ্যমতে, ক্যাম্পে জঙ্গিদের কাছে তিনটি একে ফরটি সেভেন, চারটি একে টোয়েন্টি-টু রাইফেল, ১০টি পাইপগান, ৬০০ রাউন্ড বুলেট, ১ হাজার ৩০০টি কার্তুজ, ১৫টির মতো হাতে তৈরি গ্রেনেড রয়েছে। তারা পাহাড়ের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের কাছ থেকে আরও অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছে।
ওই কর্মকর্তা জানান, ডা. আহমেদ নামে এক ব্যক্তি বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী সংগঠনের কাছ থেকে এসব অস্ত্র সংগ্রহ ও সরবরাহ করতেন। মাস কয়েক আগে জঙ্গি ক্যাম্পের আশ্রয়দাতা কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে স্থানীয় সন্ত্রাসী সংগঠন জেএসএসের গোলাগুলি হয়। ওই গোলাগুলিতে ডা. আহমেদ মারা যান। এরপর তারা কবীর নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা শুরু করেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কবীর পার্বত্য এলাকার পরিচিত অস্ত্র ব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন থানায় একাধিক অস্ত্র মামলাও রয়েছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি দল বান্দরবান এলাকা থেকে কবীরকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসারের দুই সক্রিয় সদস্য ইয়াসিন ও আব্দুর রহমানকেও গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে নাইক্ষ্যংছড়ির একটি পাহাড়ি এলাকার মাটির নিচ থেকে ড্রামে রাখা বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, এর আগে বাংলাদেশের কোনো জঙ্গি সংগঠনের কাছে অত্যাধুনিক একে ফরটি সেভেন অস্ত্র থাকার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর নিষিদ্ধ ঘোষিত নব্য জেএমবির সদস্যদের কাছে একে টোয়েন্টি-টু রাইফেল পাওয়া গিয়েছিল। এর আগে জঙ্গিরা অস্ত্রের বদলে বিস্ফোরক ব্যবহার করত বেশি।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসারের প্রধান উপদেষ্টা শামীন মাহফুজ একে ফরটি সেভেনসহ অত্যাধুনিক অস্ত্র সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি পাহাড়ি এলাকায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদার প্রয়াত নেতা ওসামা বিন লাদেনের মতো করে চলাফেরা করতেন। শামীন মাহফুজ জঙ্গি ক্যাম্পের যেখানে অবস্থান করতেন, সেখানে তিনজন তিনটি একে ফরটি সেভেন হাতে নিয়ে পাহারায় থাকতেন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, একে ফরটি সেভেন অস্ত্রগুলো ভারতের মিজোরাম থেকে কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের শীর্ষ নেতা নাথান বমের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রায় ১০ লাখ টাকা দিয়ে তিনটি একে ফরটি সেভেন সংগ্রহ করেছে। একে টোয়েন্টি-টুগুলোও পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে সংগ্রহ করা। দেশীয় পাইপগান সংগ্রহ করা হয়েছে মহেশখালী থেকে। আর স্থানীয় সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কাছ থেকে ছোট অস্ত্রগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, জামাতুল আনসারের নিজস্ব বোমা তৈরির কারিগর রয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বোমা তৈরির উপাদান সংগ্রহ করে কৌশলে তা পাহাড়ি জঙ্গি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বোমা তৈরির পাশাপাশি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অংশ নেয়া তরুণদেরও হাতে-কলমে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, জামাতুল আনসারের অস্ত্র কেনার জন্য অর্থদাতার ভূমিকায় ছিলেন মোহসিন নামে এক ব্যক্তি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা মোহসিন ইমাম নামে ওই ব্যক্তিকে মাসখানেক আগে গ্রেপ্তার করে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মোহসিন জামাতুল আনসারকে বিভিন্ন সময় অর্থ দেয়ার কথাও স্বীকার করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসারের প্রধান উপদেষ্টা শামীন মাহফুজ আল-কায়েদার আদলে সংগঠনটি তৈরি করার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক ওসামা বিন লাদেনের মতো নিজেও একে ফরটি সেভেন হাতে দুজন দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করেন। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক ইউনিট হন্যে হয়ে অভিযান চালাচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানান, শামীন মাহফুজকে গ্রেপ্তার করতে পারলে এই সংগঠনের সব অস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যাবে। জামাতুল আনসারের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র থাকায় সব সময় নিরাপত্তাঝুঁকি রয়েছে। একদিক দিয়ে কথিত হিজরতের নামে ঘরছাড়া তরুণদের গ্রেপ্তার বা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হলেও শীর্ষ নেতারা নতুন করেও অনেক তরুণকে হিজরতের নামে ঘরছাড়া করার চেষ্টা করছে। পাহাড়ের জঙ্গি ক্যাম্পে নিয়ে তাদের অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়ার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।